সন্দ্বীপ উপজেলা সদর হতে মোটর সাইকেল ও টেক্স্রী যোগে যাওয়া যায়
0
মরিয়মবিবিসাহেবানিমসজিদ।
মোহাম্মাদ শরফুল আজাদ
অবস্থানঃ বর্তমান কালাপানিয়া গ্রামের পশ্চিম দিকে, কালাপানিয়া দীঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত।
নির্মাণ কালঃ ১৬২০খ্রিষ্টাব্দ – ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর।
বর্ণনাঃ কালাপানিয়া দীঘির দক্ষিণ পশ্চিম পাশে ৩ টি গম্বুজ,৮ টি মিনার ,৩ টি দরজা ও ২ টি জানালা নিয়ে মসজিদ টি দাড়িয়ে আছে।৮ টি মিনারের মধ্যে ৪ টি মসজিদের চারপাশে চার পিলারের অগ্রভাগে, বাকি দুইটি মিনার প্রধান ফটকের দুই পাশের পিলারের অগ্রভাগে।৩ টি গম্বুজের মধ্যে ১ টি বড় ও তাঁর দুই পাশে দুইটি ছোট গম্বুজ। মসজিদের বাইরের পাশ একদম সমান কিন্তু ভেতরে মিম্বর ও জানালার স্থানগুলি মনে হয় যেন খোদাই করে বানান। দেওয়ালের পুরুত্ত প্রায় ২ হাত।গম্বুজেগুলির ভিতরের অংশ ফাঁপা, ঠিক যেন উপুড় করে রাখা নারিকেলের অর্ধেক অংশের মত।মসজিদের দুই পাশে এবং সামনে জমিদার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান।মসজিদের সামনে দীঘির পাড়, পেছনে আরেকটি ছোট পুকুর,যেটির পশ্চিম পাড় নদী গর্ভে বিলীন।১৩৭৫ বঙ্গাব্দে মসজিদটি সংস্কার করা হয়।ফলে মসজিদের দেওয়ালে অংকিত চাঁদ ও তারার প্রতিকৃতি মুছে গেছে।
ইতিহাসঃ সন্দ্বীপের স্বাধীন রাজা দিলালের (দেলওয়ার খাঁ) দুই মেয়ে ছিল। মুছা বিবি ও মরিয়ম বিবি। তাঁহার একাধিক পুত্র ছিল। তবে শুধু শরীফ খাঁ ছাড়া অন্য কারো নাম জানা যায়নি।সম্ভবত শরীফ খাঁ পিতার সঙ্গে জিনজিরায় কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান। নবাব শায়েস্তা খাঁ দিলাল রাজার বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেদের ভরন পোষণের জন্য ঢাকার অদূরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত পাথরঘাটা মিঠাপুকুর নামক স্থানে ১০/১২ খানা গ্রাম জায়গীর স্বরূপ প্রদান করেন। প্রায় ২০০ বছর পূর্বে গ্রামগুলো নদী ভাঙনে হারিয়ে যায়।তখন হতে শরীফ খাঁর বংশধরেরা সাভারের গান্ডা গ্রামে বসবাস করে আসছে। উল্লেখ্য,রাজা দিলাল কে সন্দ্বীপ হতে বন্দী করে ঢাকায় আনার সময় তার কন্যা দ্বয়ের বংশধরেরা সন্দ্বীপেই থেকে যান। ( শাশ্বত সন্দ্বীপ- এ,বি,এম ছিদ্দিক চৌধুরী, ১৯৮৮ ইং)
রাজা দিলালের প্রথম কন্যা মুছা বিবিকে বিয়ে করেন চাঁদ খাঁ ও মরিয়ম বিবি কে বিয়ে করেন মুলিশ খাঁ।,( সন্দ্বীপের ইতিহাস-রাজকুমার চক্রবর্তী ও অনঙ্গ মোহন দাস, প্রকাশকাল ১৯২৪, পৃষ্ঠা ৪৪)। মুছা বিবির নামানুসারে মুছাপুর গ্রাম ও মুছাবিবির দিঘী নামকরন করা হয় বলে জন শ্রুতি আছে।মুছাবিবির স্বামী চাঁদ খাঁর চার পুত্র ছিলেন- ১, জুনুদ খা।২, মুকিম খাঁ। ৩, সোরোল্লা খাঁ। ৪, নোরোল্লা খাঁ। জুনুদ খাঁর পুত্র মোহাম্মাদ রাজা, মোহাম্মাদ রাজার পুত্র আবু তোরাব ও কন্যা ফুলবিবি।অন্য দিকে মুকিম খাঁর ছেলে মোহাম্মাদ হোসেন, মোহাম্মাদ হোসেনের পুত্র মোহাম্মাদ মুরাদ।
এই মুরাদ বিয়ে করেন জুনুদ খাঁর নাতনি ফুল বিবিকে।মুরাদ ও ফুল বিবির ঘরে জন্মে মোহাম্মাদ হানিফ, যিনি পরবর্তীতে জমিদারী প্রাপ্ত হন। ( শাশ্বত সন্দ্বীপ- এ,বি,এম ছিদ্দিক চৌধুরী, ১৯৮৮ ইং)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মরিয়ম বিবি ছিলেন দিলাল রাজার কন্যা, অন্যদিকে ফুল বিবি ছিলেন দিলাল রাজার নাতি জুনুদ খাঁর নাতনি।
ফুল বিবির ভাই আবু তোরাব চৌধুরী হরিশপুরে এক প্রকাণ্ড রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। এই বাড়ির সামনেই প্রসিদ্ধ চৌধুরীর বাজার( চারি আনির হাট) অবস্থিত। এই বাড়ির সামনেই ছিল ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদ।রাজকুমার চক্রবর্তী ও অনঙ্গ মোহন দাস রচিত “সন্দ্বীপের ইতিহাস” বইয়ে এই মসজিদের নির্মাণ সাল উল্লেখ আছে ১৭৭৪ইং।কিন্তু সিহাব উদ্দিন তালিশ তার “ ফাতেহা আসাম” বইটি রচনা করেন ১৬৬৩ ইং এ, ওই বইয়ে ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদের উল্লেখ ছিল। তাহলে এটাই প্রমানিত হয় এটি ১৬৬৩ ইং এর আগে নির্মিত হয়। কেউ কেউ বলেন ফুল বিবি দিলাল রাজার মেয়ে ছিলেন, কিন্তু কোন ইতিহাসে এর প্রমান পাওয়া যায়না।
এবার, এ,বি,এম ছিদ্দিক চৌধুরী রচিত “শাশ্বত সন্দ্বীপ’(১৯৮৮ ইং, পৃষ্ঠা ৭৩) বইয়ের কিছু অংশ তুলে ধরা হল। “ নবাবি আমলে যে কয়েকজন ক্ষণজন্মা বীরপুরুষের অভ্যুদয়ে বাংলার মুসলমানেরা ধন্য ও বাংলার ইতিহাস গৌরব মণ্ডিত হয়েছে তাদের মধ্যে সন্দ্বীপ পরগনার রাজা দেলওয়ার খাঁ অন্যতম। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় তাঁর মত প্রভাবশালী শাসক ছিলনা বললে অত্যুক্তি হবেনা।তিনি হিম্মত ও হেকমতে অপ্রতিহত প্রভাবে প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবত সন্দ্বীপ পরগনা শাসন করেন। তিনি দিলাল রাজা নামে সাধারন মানুষের কাছে পরিচিত। দেলওয়ার খাঁ সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ( ১৬০৫-১৬২৭) ঢাকায় নৌ সেনাপতি ছিলেন। ১৬১৮-১৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর তিনি সন্দ্বীপ গমন করেন এবং সেখানে স্থায়ী ভাবে বসতি স্থাপন করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতে থাকেন। ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে ডিসেম্বর( Calcutta Review, July 1871) মোঘলদের হাতে বন্দী হয়ে ঢাকার জিনজিরায় অন্তরীন হন এবং সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন”।
জুনুদ খাঁ ছিলেন দিলাল রাজার নাতি, আবু তোরাব ছিলেন জুনুদ খাঁর নাতি। দিলাল রাজা যদি ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান, তাঁর মানে তিনি ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন, সেই একই সময়ে তাঁর পাঁচ প্রজন্মের পরের আবু তোরাব চৌধুরী কিভাবে ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদ নির্মাণ করবেন? দিলাল রাজার মৃত্যুর সময় তাঁর নাতি জুনুদ খাঁর বয়স যদি ২০ বছর ও ধরা হয় তাহলে জুনুদ খাঁর নাতি আবু তোরাবের পক্ষে ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদ ১৭৫০ সালের পূর্বে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তাহলে ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, এটায় অধিক যুক্তিযুক্ত।
অপরদিকে দিলালের অন্য মেয়ে মরিয়ম বিবির বংশধরদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি।দিলাল রাজা যদি ১৬১৮-১৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর সন্দ্বীপ আগমন করেন, তখন ছিল তাঁর যৌবন কাল। মরিয়ম বিবি ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা, তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে অর্থাৎ ১৬৬৫ সালের পূর্বেই তাঁর মেয়ের নামে মরিয়ম বিবি সাহেবানি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। ( আমেরিকা থেকে কালাপানিয়া সমাজকল্যন সমিতি প্রকাশিত “ মেঘনা পাড়ের গাঁও” ম্যাগাজিনে এই মসজিদের নির্মাণ কাল ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ বলে উল্লেখ্য করা হয়, যা আদৌ সত্য নয়।প্রবন্ধের শেষে দ্রষ্টব্য।)
কালাপানিয়ায় অবস্থিত এই মসজিদ অবিকল ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদের অনুরুপ। যেহেতু মরিয়ম বিবি সাহেবানি মসজিদ আগে নির্মাণ করা হয়, হয়তো বা, আবু তোরাব চৌধুরী এই মসজিদের অনুকরনে তাঁর বোনের নামে ( কারো কারো মতে আবু তোরাব চৌধুরীর ভগ্নীপতি মুরাদ তাঁর স্ত্রীর নামে এই মসজিদ নির্মাণ করেন, কারন সন্দ্বীপের চার আনি সম্পত্তি নাকি মুরাদ জমিদারী প্রাপ্ত হয়েছিলেন, এইজন্যে চৌধুরীর হাট চার আনির হাট নামেও পরিচিত) নির্মাণ করেছিলেন।
ফুল বিবি ও তাঁর ভাইয়ের ছেলে আলি রেজা চৌধুরীর জমিদারী রাজস্ব দায়ে নিলাম হয়ে যায়। ফুল বিবির অংশ ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ই নভেম্বর ও আলি রেজার অংশ ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট নিলামে বিক্রি হয়ে সরকারের হাতে চলে যায়।১৮২৫ খ্রিস্তাব্দে ১১ আগস্ট সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সন্দ্বীপের সকল জমিদারের ভাগ্য চিরকালের জন্য নিভে যায়। সন্দ্বীপের বিশাল একটি জমিদারী ১৮৪৫ খ্রিস্তাব্দে কালাপানিয়া নিবাসী মনোহর আলী চৌধুরী ওরফে পেয়ার মোহাম্মাদ মজুমদার এর পুত্র সরাফত আলী চৌধুরীর নিকট ২২ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। এই মনোহর আলী মুর্শিদাবাদ হতে সন্দ্বীপ এসে বসতি স্থাপন করেন।সরাফত আলীর পিতা পেয়ার মজুমদারের পক্ষে ১৭৫০ দশকে মরিয়ম বিবি সাহেবানি মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব ছিলনা, কারন ১৮৪৫ খ্রিস্তাব্দে জমিদারী প্রাপ্ত হয়েছিলেন সরাফত আলী চৌধুরী, পেয়ার মোহাম্মাদ মজুমদার নন।কালাপানিয়ায় যে দীঘির পাড়ে মসজিদ টি ( মরিয়ম বিবি সাহেবানি) অবস্থিত সেই দিঘীটি বর্তমানে চৌধুরী দিঘী বা কালাপানিয়া দিঘী নামে পরিচিত।(সরাফত আলী চৌধুরীর ভাই মোহাম্মাদ আলী চৌধুরী, মোহাম্মাদ আলী চৌধুরীর পুত্র খূরশিদ আলম চৌধুরী।এই দীঘির দক্ষিণ পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি বাড়ির দরজা, যে বাড়িটি বর্তমানে খূরশিদ আলম চৌধুরী বাড়ি নামে পরিচিত। এই খূরশিদ আলম চৌধুরীর জামাতা হালিম উল্লাহ চৌধুরী, যিনি কালাপানিয়ার ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট।হালিম উল্লাহ চৌধুরী সন্দ্বীপের প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান ভাষা সৈনিক একে,এম রফিকুল্লাহ চৌধুরীর পিতা।)
প্রমত্ত মেঘনা গ্রাস করেছে এই জমিদার বাড়ি। সন্দ্বীপের প্রাচীন স্থাপত্যের আরেকটি নিদর্শন ফুল বিবি সাহেবানি মসজিদ ১৯৮১ সালের ২৯ শে জুন সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অবশিষ্ট আছে শুধু মরিয়ম বিবি সাহেবানি মসজিদ। নদী গর্ভ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে দাড়িয়ে আছে সন্দ্বীপের স্বাধীন রাজা দিলালের মেয়ের স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন এই মসজিদ। হয়তো বা বছর ঘুরতেই আর দেখা যাবেনা দীঘির পানিতে প্রতিবিম্ব ফেলে দাড়িয়ে থাকা ইতিহাসের রাজসাক্ষী।
তথ্যসুত্রঃ ১। শাশ্বত সন্দ্বীপ- এ,বি,এম ছিদ্দিক চৌধুরী, ১৯৮৮ ইং।
২। “সন্দ্বীপের ইতিহাস” রাজকুমার চক্রবর্তী ও অনঙ্গ মোহন, ১৯২৪ ইং।
৩। “ মেঘনা পাড়ের গাঁও”- কালাপানিয়া সমাজকল্যন সংঘ,USA থেকে প্রকাশিত”
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS